সাম্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান

স্বাস্থ্য


সাম্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন কবি, সাংবাদিক ও সমালোচক হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে অবিচল আস্থাশীল ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নেন।তিনি মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার জন্য বিখ্যাত।

হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন।

হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালে ১৪ জুন জামালপুর জেলায় তার নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি ছিল জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুর রহমান এবং মায়ের নাম হাফিজা খাতুন। ১৯৫৮ সালের ১৭ এপ্রিল হাসান হাফিজুর রহমান সাঈদা হাসানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান।

১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৩৯ সালে তার বাবা বরিশালে বদলি হয়ে গেলে তিন বছর জামালপুরের সিংজানী হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তার বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশোনা করেন। ১৯৪৬ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি.এ. অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম পর্ব এম.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন।

চাকরি জীবনের পুরো সময় তিনি ঢাকা শহরেই অতিবাহিত করেন। তবে ১৯৩৯-১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশালে কর্মরত ছিলেন। চাকরি ছাড়াও তার আয়ের উৎস ছিল গ্রামের ভূ-সম্পত্তি।

হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন খুব বৈচিত্র্যময় ছিল। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১৯৫২ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একাধারে সওগাত, ইত্তেহাদ ও দৈনিক পাকিস্তান এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ সালে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৬ সালে তিনি যখন স্কুলছাত্র, তখন তার ছোট গল্প ‘অশ্রুভেজা পথ চলাতে’ প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। এর দু বছর পর সোনার বাংলায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন। একুশের চেতনার উপর ভিত্তি করে তার কবিতা অমর একুশে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেই। এটি সহ আরও কিছু লেখা একত্রিত করে ১৯৫৩ সালে তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন।

হাসান হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে বছর তিনি নাট্য চক্রের সভাপতি হন এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেন। সেগুলো হলো- কবিতার বিষয়বস্তু ও আধুনিক কবিতার লক্ষণ। ষাটের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলার অক্ষর বদলে আরবি অক্ষরে রূপান্তরের ষড়যন্ত্র ও রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবিতে জোরালো আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। হাসান হাফিজুর রহমান বেশি পরিচিত তার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খণ্ডের দলিলপত্রের (১৯৮২-৮৩) সম্পাদনার জন্য।

বাংলা ভাষায় হোমারের ওডিসি অনুবাদ করেছেন হাসান হাফিজুর রহমান। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে-

কাব্যগ্রন্থ- বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮), আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫), মূল্যবোধের জন্যে (১৯৭০), অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮), যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২), শোকার্ত তরবারী (১৯৮১), প্রতিবিম্ব (১৯৭৬),
আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০),ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী(১৯৮৩) ইত্যাদি।

প্রবন্ধ- আধুনিক কবি ও কবিতা(১৯৬৫), মূল্যবোধের জন্য(১৯৭০), সাহিত্য প্রসঙ্গ(১৯৭৩), আলোকিত গহবর(১৯৭৭)

এছাড়াও রয়েছে- গল্পগ্রন্ধ ‘আরো দুটি মৃত্যু’, ভ্রমণকাহিনী ‘সীমান্ত শিবিরে’।

পুরস্কার ও পদক
হাসান হাফিজুর রহমান তার কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১), সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২) ও মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪) পেয়েছেন।

এ দেশের সাহিত্য ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০২ সালে দেশের ‘সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে।

বাংলাদেশ জার্নাল/পিএল