রমজান মাস মুসলমানদের জন্য ইবাদতের অন্যতম মাস। ত্রিশ দিন ভোররাতে সেহরি করে সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতার করেন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর আবাসিক শিক্ষার্থীদের জীবনও এর বাইরে নয়। করোনাকালীন ক্ষতি পোষাতে রমজানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়েও চলমান রয়েছে সশরীরে শ্রেণী কার্যক্রম।
যার ফলে খোলা রয়েছে সবগুলো আবাসিক হল। ১৯ টি হলের মধ্যে জগন্নাথ হল ব্যতীত বাকি ১৮ টি হলেই মুসলমান শিক্ষার্থীরা থাকেন। তারা জানান, হলের খাবারের দাম ও মান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রমজানে খাবারের দাম বাড়লেও বাড়েনি পরিমাণ ও গুণগত মান। হলগুলোতে আইটেমের নামে কয়েকটি পদ একত্র করে রাখা হচ্ছে চড়া দাম। রমজানে এমনিতেই খরচ বেশি হওয়ার কথা উল্লেখ করে ক্যান্টিনের এমন বেহাল দশায় নিজেদের ভোগান্তির কথা জানান একাধিক শিক্ষার্থী! ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই কোনো সদোত্তর। হল প্রশাসনও বলছে ‘ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
দাম বাড়লেও বাড়েনি খাবারের মান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সাধারণত ৩ বেলার খাবার প্রস্তুত করা হয়। সকাল, দুপুর আর রাতের খাবার। তবে রমজানের এক মাস শুধু সেহরির আয়োজন থাকে ক্যান্টিনগুলো। আবাসিক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তিন বেলার আয় পোষাতে সেহরির একবেলার খাবারের দাম বাড়িয়েছে হল ক্যান্টিনগুলো। একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাবারের নাম পরিবর্তন করে, কিছু পদ একত্র করে প্রতারণামূলক ভাবে খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ। তবে এর সঙ্গে খাবারের মান ও পরিমাণের নেই বিশেষ কোনো পরিবর্তন। ফলে খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
সূর্যসেন হল ক্যান্টিনে প্রথম রোজার সেহেরি খেয়েছেন ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী তোফাজ্জল হোসেন আসিফ। তিনিও মুখোমুখি হয়েছেন ঠিক একই ধরণের সমস্যার। এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, সূর্যসেন হলে আমি আমার বন্ধুসহ সেহেরি করতে যাই। মুরগী, ডিম, সবজি, ডাল ও সালাদের (ভাতসহ) দাম রাখা হয় ৭০ টাকা। অথচ অন্যান্য সময় ভাতসহ মুরগীর মাংসের দাম থাকে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ভেতরে। পাশাপাশি পদের নাম উল্লেখ থাকলেও ডাল আর সবজির দেখা মেলেনি ক্যান্টিনে। এছাড়াও পরিবেশন করা ভাজা ডিম দেখে মনে হচ্ছিলো না এখানে কোনো পূর্ণ ডিম দেয়া হয়েছে। সালাদের নামে দেয়া হয়েছে ২ টুকরো পাতলা করে কাটা গাজর।
তিনি আরও বলেন, রমজান মাসে আমরা অনেক কষ্ট করে হলে থাকি। তার উপর খাবারের অবস্থা এরকম হলে আমাদের চলা আরও কঠিন হয়ে যায়। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ দিকটিতে নজর দেবে।
সরেজমিনে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ক্যান্টিনেও দেখা যায় একই চিত্র। গরুর মাংস, হাফ ডিম, সবজি ও সালাদের দাম রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা (ভাত ও ডালসহ)। দেয়া হচ্ছে এক টুকরো মাংস, ৫ টাকা পরিমাণ সবজি, অর্ধেক সেদ্ধ ডিম। সালাদের নামে দেয়া হচ্ছে গোল করে কাটা মোট দুই টুকরো শসা ও গাজর। তবে পূর্বে হলগুলোতে গরুর মাংসের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা (ভাত ও ডালসহ)।
এ বিষয়ে কবি জসীম উদ্দীন হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমার হলেও আইটেমের নামে কিছু নামমাত্র পদ যুক্ত করে বাড়ানো হয়েছে দাম। অথচ খাবার মুখে নেয়ার জো নেই। ক্যান্টিনে খোঁজ নিলে মনে হয় ১০ টাও ভালো প্লেট পাওয়া যাবে না। সব ভাঙা, দাগে ভরা। এই প্লেটে খাওয়া-দাওয়া করা রুচিতে বাধে। আর ক্যান্টিন বয়দের একেকজন তো নবাবের মতো। দশবার ডাকলে একবার শোনে। খাবারের বিষয়ে তো আমাদের অভিযোগ অনেকদিনের। তবুও বাধ্য হয়ে আমাদের ক্যান্টিনে খেতে হয়। আদৌ প্রশাসন এগুলোর কোনো সুরাহা করবে কি না আমাদের জানা নেই।
তবে মেসের খাবার নিয়ে ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী। তারা জানান, মেসের খাবার হল ক্যান্টিনের তুলনায় অনেকাংশে ভালো। খাবারের মান ও পরিমাণ দুটোই সন্তোষজনক। তবে মেসে আগে পূর্ণ টাকা দিয়ে দিতে হয় বলে অনেক শিক্ষার্থী মেসে কার্ড করতে পারে না। হল ক্যান্টিনগুলো যদি মেসের মতো মান বজায় রাখার চেষ্টা করে তবে সবার জন্য উপকার হবে বলে জানান তারা।
এ কী বলছে ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ
ক্যান্টিনের খাবারের দাম বৃদ্ধি ও মানের বেহাল দশার অভিযোগের বিষয়ে কবি জসীম উদ্দীন হল ক্যান্টিনের ম্যানেজার মোবারক কথা বলেন বাংলাদেশ জার্নালের সঙ্গে। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের খাবারের দাম বাড়াতে হয়েছে। এখন গরুর কেজি ৭৫০ টাকা, মুরগী ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। কয়েকদিন পর দেখা যাবে আবার দাম কমে যাবে।
হলের মেসে দৈনিক ৭০ টাকা খরচে গরুর মাংস, পাবদা মাছ, সালাদ ও ফিরনি দিতে পারলে ক্যান্টিন কেন এসব করতে পারছে না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মেসে কর্মচারী কম। দেখা গেছে ওদের ৫ জন থাকলে আমাদের থাকে ২০ জন। পাশাপাশি ওরা সম্পূর্ণ টাকাটা আগে নিয়ে নেয়। তাই তারা ম্যানেজ করতে পারে।
দাম অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ ও গুণগত মান ঠিক না থাকার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এত জন কর্মচারী নিয়ে আমরা তিন বেলার জায়গায় এখন ক্যান্টিন চালাই শুধু এক বেলা। পাশাপাশি সবকিছুর দামও বেড়েছে। এ কারণে হয়তোবা ২/৪ টাকা এদিক সেদিক হয়।
সামনে দাম কমবে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ক্যান্টিন তো চালাবই ১০/১৫ দিন। এরপর তো শেষই। কর্মচারীদের ১ মাসের বেতন দিতে হবে।
হল প্রশাসনের কী উদ্যোগ
খাবারের দাম ও মানের সার্বিক বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছিরের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ জার্নালের। মেসের খাবারের তুলনায় হল ক্যান্টিনের খাবারের মাত্রাতিরিক্ত নিম্নমানের বিষয়ে তিনি বলেন, মেসে যেহেতু সবাই নিজেরা বাজার করে খায় সেহেতু মেসের সাথে ক্যান্টিনের একটু পার্থক্য তো হবেই। ক্যান্টিনের যারা আছে ওরা একটু ব্যবসা করতে চায়। ফলে অল্প পার্থক্য তো সবসময়ই ছিলো। এখনও হয়তো আছে। তবে এটি আকাশ-পাতাল হওয়ার সম্ভাবনা তো আমরা মানতে পারি না।
নামমাত্র কিছু পদ যুক্ত করে দাম বাড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তো কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরাও তো শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের সন্তানরাও শিক্ষার্থী। আমরাও বাসায় বাজার করি, দৈনন্দিন জীবনযাপন করি। এগুলো মেনে নেয়ার মতো বিষয় নয়!
এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মোটামুটি অনেক প্রভোস্টের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। ৫ এপ্রিল প্রভোস্ট কমিটির সভা আছে। সেখানে আমরা কোথায় খাবারের দাম কম-বেশি, কী হলো না হলো, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব। কোনো হল কর্তৃপক্ষ যদি সেটা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে না থাকে আমরা স্ব স্ব হলের প্রভোস্টকে সরেজমিনে গিয়ে বিষয়গুলোর পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করব।
বাংলাদেশ জার্নাল/কেএ