মজিদ মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘অণুবিশ্বের কবিতা’ ও ‘ভালোবাসা পরভাষা’

স্বাস্থ্য


মজিদ মাহমুদকে (জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬) যারা চেনেন-জানেন, সাহিত্য আলাপ-আলোচনায় তার সাথে কিছুটা সখ্য গড়ে উঠেছে, তারা তাকে বলে থাকেন, জীবন্ত লাইব্রেরি। কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে কোনো শাখা নিয়ে তারা সাথে একবার কথা বলা শুরু করলে বোঝা যায় তার পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত ও গভীর এবং স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর। যে কোনো বিষয়ে তিনি অনর্গল কথা বলে বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারেন। তার কথনভঙ্গি এবং ব্যতিক্রম বিচিত্র চিন্তার নান্দনিক রূপায়ন প্রবন্ধসম্ভার। ‘নান্দনিক’ শব্দটি এখানে কতটা নান্দনিক হয়ে উঠল সে বিষয়ে অবশ্য কিছুটা দ্বিধারই উদ্রেক হয়। কারণ প্রবন্ধ বলতে আমরা প্রচলিত যে কাঠামো বুঝি, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা তাঁর আগে থেকে শুরু করে বর্তমান অবধি শব্দ প্রয়োগে ভাষার কৃত্রিম কাঠামো তৈরি মজিদ মাহমুদ তা পুরোপুরি অস্বীকার করে প্রমিত কথ্যভাষাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধের ভাষার সাথে মঞ্চে বক্তৃতার ভাষা কিংবা সাধারণ আলাপ-আলোচনার ভাষার মধ্যে বিভাজন তৈরি করা যায় না বললেই চলে। সহজ-সরল কথ্য ভাষায় জীবন ও জগতের জটিল-কুটিল-কঠিন বিষয়কে তিনি অবলীলায় উপস্থাপন করতে পারেন। ফলে তাঁর প্রবন্ধ হয়ে ওঠে সবার জন্য সুখপাঠ্য।

কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধে নীরব ও নান্দনিক বিদ্রোহ শুরু করেছেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজা মঙ্গল’ থেকেই। মধ্যযুগের মঙ্গল কবিদের অনুসরণে, বুঝে কিংবা না-বুঝেই হোক, আশির দশকে সেই তরুণ বয়সে, প্রথম কাব্যগ্রন্থের ঐরূপ নামকরণ দুঃসাহসই বটে, পশ্চাৎকে তিনি অগ্রে টেনে নিয়ে এসেছেন। তখন কিছুটা সমালোচনা হলেও পরবর্তীতে অনেক কবিই কাব্যগ্রন্থের নামকরণে ‘মঙ্গল’ শব্দটি জুড়ে দিয়েছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। শুধু তাই নয়, ‘মাহফুজা মঙ্গল’ এর কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম ও শব্দপ্রয়োগকৌশল দ্বারাও পরে অনেক কবি ও সাহিত্যিক প্রভাবিত হয়েছেন। এ তো গেল ভাষার দিক। কিন্তু বিষয়ের দিকেও ‘মাহফুজামঙ্গল’ ধর্মীয় অচলয়াতন ভেঙে নতুন চেতনার জন্ম দিয়ে বিদ্রোহ প্রদর্শন করেছে। প্রেমিকের কাছে নারী বা প্রেমিকার শরীরও যে এবাদত হয়ে উঠতে পারে, এই প্রথম আমরা জানলাম। টেড হিউজ কাককে ঈশ্বরের প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়েছেন ‘দি ক্রো’ কাব্যগ্রন্থে। আর মজিদ মাহমুদ মাহফুজাকে দাঁড় করিয়েছেন ঈশ্বরের প্রতিপক্ষরূপে ‘ইশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায় / আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে / সেই নারী এসে আমার হৃদয়-মন তোলপাড় করে যায় / আমার রুকু / আমার সেজদা / জায়নামাজ চেনে না’। ঈশ্বর ও মাহফুজা পরস্পরের প্রতিরূপ। প্রেমিকাকে এরূপে উপস্থাপনের খবর যদি ধর্মান্ধ মৌলানারা জানতো, তাহলে মজিদ মাহমুদকে মুরতাদ ঘোষণা করে দেশছাড়ার জন্য তুমুল আন্দোলনে তারা ঝাপিয়ে পড়তো এতদিনে। যাহোক প্রথম কাব্যগ্রন্থেই মজিদ মাহমুদ বাংলা কবিতায় সুদূর প্রভাব বিস্তারি ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন নীরবে। তারপর ‘ গোষ্ঠের দিকে (১৯৯৬), বল উপাখ্যান (২০০০), আপেল কাহিনি (২০০২), ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম (২০০৬) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে কবিতার ফর্ম ভেঙে নিজস্ব ফর্ম ও ভাষাশৈলী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব পেয়েছে কথ্যভাষা। বিষয় ও চিন্তায় বিচিত্র বহুগামী তাঁর কবিতা। কবিতা সম্পর্কে আল মাহমুদ যেমন বলেছেন, ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়শা আক্তার’। সেখান থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে মজিদ মাহমুদ বলেন, ‘কবিতাকে কবিতা হতে দেখলেই আমি বিরক্ত হই/ কবিতা কবিতার মতো হলে আর পড়তে ইচ্ছে করে না / মনে হয় সাজানো গোছানো / মনে হয় কেউ লিখতে চেয়েছিল / মনে হয় বিয়ের আগে পার্লারে গিয়ে সেজেছে অনেক / এসব সাজাটাজা তো একদিনের ব্যাপার / সবাইকে দেখানোর জন্য, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য / গায়ের রঙ চড়ানোর পরে / দামি অলঙ্কার ও শাড়ির আড়ালে / পরচুলা ও ভ্রু প্লাক করার পরে / আসল কনে যেমন হারিয়ে যায়’।

উত্তরাধুনিক ভাবনায় চিত্রকল্প প্রয়োগে কিংবা অপ্রয়োগে, ভাষা ও শব্দের কৃত্রিমতার মোড়কে কবিতাকে পাঠকের বোধগম্যহীন করে তোলেছেন অনেক কবি। মজিদ মাহমুদ এ থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। কত্রিমতা বর্জিত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা ও চিত্রকল্প তৈরি করে পাঠকের উপলব্ধির জগতে নীরবে টুকা দিতে চেয়েছেন তিনি। কবিতা যদি পাঠকের হৃদয়-আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় চিত্রকল্প, ভাষা কিংবা শব্দ প্রয়োগকৌশলে, তাহলে সেই কবিতার ভবিষ্যত অনুজ্জ্বল, ব্যর্থ। তাঁর মতে, ‘হৃদয়-আবেদন কবির প্রথম এবং প্রধান শর্ত। জীবন জগতের কোনো এক গূঢ় রহস্য যখন কবি আবিষ্কার করেন, এবং ভাবেন এ কথা তার মতো করে কেউ ভাবেন নি কিংবা এমন করে কেউ বলেন নি, তখন তিনি বলার মাধ্যম হিসাবে কবিতাকে বেছে নেন।’ জীবন ও জগত দেখার গভীর কোনো উপলব্ধি, চারপাশের প্রতিবেশের কোনো দৃশ্য বা ঘটনা যখন কবিমনে রেখাপাত সৃষ্টি করে কিংবা আনন্দ-বেদনার জন্ম দেয় তখন একটি কবিতার জন্ম হতে পারে। তবে একই ঘটনা, বস্তু বা দৃশ্য দেখার চোখ এবং তা উপস্থাপনকৌশল সবার এক নয়। এখানেই কবির কবিত্বশক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটে। কবি মজিদ মাহমুদের সাথে ‘কবিতা নির্মাণ’ প্রসঙ্গে আমিও সহমত পোষণ করি। কারণ ‘নির্মাণ’ শব্দটির সাথে পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা, ছক বা নকশা থাকে। সাহিত্যের অন্য শাখায় এর সত্যতা কিছুটা থাকলেও কবিতার ক্ষেত্রে একেবারেই অর্থহীন। কবিতা তো তাৎক্ষণিক উপলব্ধি ও ভাবের নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ। পরিকল্পনা, নকশা বা ছক তৈরি করে কবিতা লেখা যায় না। যদি তা করা হয়, তাহলে তা হবে কৃত্রিম, শৃঙ্খলে বন্দি। কবিতা সব সময় শৃঙ্খলার পরিপন্থি, নিয়মকে অস্বীকার করে নতুনত্বের জন্ম দেয়। উপলব্ধির জটিল অন্তর্জালের ব্যতিক্রম প্রকাশ এবং অনির্দিষ্ট ও অনির্ণেয় গন্তব্যের দিকে কবিতার অন্তহীন যাত্রা। এ যাত্রায় ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রভাববিস্তারি ক্ষমতা না থাকলে কালের জলস্রোতে মিশে কবি হারিয়ে যান। আমার তো মনে হয় মজিদ মাহমুদ ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রভাববিস্তারি ক্ষমতা নিয়েই কবিতার মাঠে নেমেছেন। কবিতার যত শাখা-উপশাখা আছে, সব জায়গায় তিনি নিত্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। কবিতার ফর্ম বা কাঠামো ভেঙেচুরে নতুন অবয়বে পাঠকের সামনে হাজির করেন। সম্প্রতি তাঁর ‘অনুবিশ্বের কবিতা’ (২০০৮), ‘কাপলেট’ বা ‘ম্যাক্সিম’ পড়ে এ ধারণা পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। তবে তাঁর ‘অনুবিশ্বের কবিতা’ ও ‘ভালোবাসা পরভাষা’ এদুটি গ্রন্থ ব্যতিত আপাতত আমার আলোচনা অন্যদিকে টার্ন করার কোনো সুযোগ নেই। জীবন ও জগতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মজিদ মাহমুদের যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপলব্ধি বা দর্শন তাই তিনি তুলে ধরেছেন এই ‘অনুবিশ্বের কবিতা’য়। এটাকে হাইকু বা সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতাও বলা যাবে না। জাপানি হাইকুতে তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ মোট ১৭ মাত্রা থাকে। মজিদ মাহমুদ এ নিয়ম মেনে চলেন নি এবং তিনি দাবিও করেন নি এগুলো হাইকু কবিতা। তিনি ছোট ছোট পংক্তিতে আলাদা ফর্মে লিখে এ কবিতা গ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘অনুবিশ্বের কবিতা’। দুই, তিন, চার পংক্তির কবিতাই বেশি। পাঁচ ছয় পংক্তি বা সর্বোচ্চ দু একটি কবিতা স্বল্প দৈর্ঘ্যরে আট দশ পংক্তিরও আছে। পংক্তি কম বা ক্ষুদ্র হলেও প্রতিটি কবিতায় তিনি গভীর দর্শন ও উপলব্ধি, তীক্ষ্ণ অনুভব ও ভাবের এক বৃহৎ জগতই সৃষ্টি করেছেন যা সহজেই পাঠকের হৃদয়-আবেদন তৈরি করে।
ক) ‘ শৃঙ্খলিত সিংহের চেয়ে স্বাধীন গর্দভ শ্রেয়


প্রিয়তমা আমি তোমার স্বাধীন গর্দভ।’ [গর্দভ]

খ) ‘নির্বোধ কবি খোঁজে নির্বোধ চাটুকার শ্রোতা


আমার কবিতা পড়ে বিহঙ্গ নদী মাঠ গিন্ত নীরবতা’ [কবি]

গ) ‘অগোছালো হয় জানি প্রেমিকের বাক্যের বিন্যাস


তুমি তো গুছিয়ে কথা বলো


তোমার প্রেমের প্রতি তাই আমার অবিশ্বাস’ [ প্রতারক]

ঘ) ‘তুমি হিন্দু সব হিন্দু কি তোমার ভাই


তুমি মুসলিম নিজের জাতের বিরুদ্ধে কী লড় নাই


তবে কেন ধর্মের নামে আলাদা লড়াই’ [ধর্ম]

ঙ) ‘তোমার ভয় চোরে নেবে সম্পদ


তোমার ভয় এক্সিডেন্টে হয়ে যাবে বিপন্ন


ভাবো তো ভাই আগে কোথায় তুমি ছিলে


কিছু দিন পরে কোথায় যাবে তুমি।’ [মালিক]

চ) ‘তুমি যাকে বলো জীবনের সঞ্চয়, সে তো শুধু দেনা
তুমি যা নিজের বলে জানো তা তো তোমার ছিল না। [দেনা]

আরও অনেক কবিতা ‘অনুবিশ্বের কবিতা’ থেকে তুলে ধরা যায়। অনেক কবিতা মনে হতে পারে হাফিজ কিংবা রুমি দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু তা দোষের কিছু নয়। চিন্তায় তিনি তাদের অনুসারী হলেও কবিতার ফর্ম তিনি নিজের মতো করেই গড়ে নিয়েছেন। মজিদ মাহমুদ এই ‘অনুবিশ্বের কবিতা’য় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের খণ্ডিত চিত্র, প্রেম, বিরহ, ঘৃণা, হিংসা, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, ব্যক্তি উপলব্ধির অন্তর্গত রূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন। কবিতা পড়লেই মনে হয় এই তো আমাদের চেনাজানা পরিসর, চারপাশের মানুষ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের মুখোশ তিনি উন্মোচন করেছেন। ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়েছেন কঠিন প্রশ্ন ও সত্যের মুখোমুখি। তুমি কে, কোথা থেকে এসেছো, কোথায় যাবে। এই পৃথিবীতে তুমি ক্ষণস্থায়ী, এই নশ্বরদেহ অচিরেই ছেড়ে যেতে হবে। কাজেই অর্থ-বিত্ত সবই অর্থহীন। ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে সমাজে এত যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তগঙ্গা বয়ে যায়, অগণিত জীবন নাশ হয়, কেন? এই প্রশ্ন হয়তো সহজ? কিন্তু ব্যক্তিগত উপলব্ধি সহজ নয়। মজিদ মাহমুদ সেই উপলব্ধির দরোজায় নীরবে করাঘাত করেছেন। মানুষকে ফেরাতে চেয়েছেন মনুষ্যত্ব ও বিবেকের কাছে। ব্যক্তি নিজেকেই নিজে উন্মোচন করে সত্য ও মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। চিনতে পারে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অগণিত ঘূণপোকা।
মজিদ মাহমুদের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে সাহিত্যপাড়ায় যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, আবছায়া বা অন্ধকার তৈরি হয়েছে, তার যথোচিত জবাবও তিনি দিয়েছেন অনুবিশ্বের কবিতায়। সত্য-মিথ্যার এই দ্বন্দ্বে একজন কবিকে যখন জড়ানো হয়, তখন তিনি ভেতরে ভেতরে কতটা রক্তক্ষরিত হন, তা আমরা দেখতে পাই ‘বিবেচনা’ কবিতায়।

‘তুমি বলো জিয়াপন্থী আমি, তুমি বলো মুজিববাদী


কেউ বলে আমার অন্তরে গেড়েছে মৌলবাদ

গভীর নিশিত জেগে একা একা কাঁদি’

কবির এই কান্না কি শুনতে পাবেন তারা? রাজনৈতিক বিশ্বাস তো সবার চিরস্থায়ী নয়। আমাদের দেশে তো নয়ই। মওকা পেলে কতজনেই বদলে যায়। ভোল পাল্টে ফেলে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্বাসে থিতু হওয়া মানেই নিজের অন্ধত্বকে মেনে নেয়া, তা না হলে সে রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবে না। একজন প্রকৃত কবি কখনো অন্ধ হতে পারে না। সত্য ও মিথ্যা তার বিবেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সুবিধাবাদী কর্মীরা তার ওপর প্রলেপ দেয় এক একটি রাজনৈতিক রঙের। এই সব দলের গ্রহণ-বর্জন এড়িয়ে সত্যনিষ্ঠ হয়ে সৃষ্টিমগ্ন হতে হয়। কে কী বললো তাতে কী আসে যায়। কদিন পর এসব থাকবে না। তখন বিবেচ্য হবে কবির প্রকৃত কাজের। একমাত্র সৃষ্টিমগ্নতাই কবিকে মুক্তি দিতে পারে এ সব জঞ্জাল থেকে।

‘অনুবিশ্বের কবিতা’য় মজিদ মাহমুদ মিথেরও ব্যবহার করেছেন। সীতার সতীত্ব পরীক্ষাকে নিয়ে এসেছেন সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় ও জীবনচেতনায়। তাঁর ভাবনার খণ্ডিত বিশ্ব মূলত মানবের মর্মচৈতন্যেরই সারাৎসার। ‘ভালোবাসা পরভাষা’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। এখানে মিথ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মরমিয়চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কবিতাগুলো। ভালোবাসা মানবমনের চিরন্তন আকাক্সক্ষা। গভীরতর অনুভব। শুধু নরনারীর মিলনাকাক্সক্ষা, বিচ্ছেদ ও বিরহের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। যুগে যুগে দেশে দেশে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে মিলনবাসনা, বিচ্ছেদ-বেদনা অভিন্ন প্রেম অনুভবে মূর্ত হয়ে ওঠে। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো ভাষা নেই। তা হতে পারে ইঙ্গিত, সংকেত ও প্রতীকময়তা। অখ সময়প্রবাহে অবিনশ্বরকে স্পর্শ করার বহমান নশ্বর জীবনের মগ্ন আকুলতাই ভালোবাসা। মিথ, ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস ও সাধনতত্তে¡র রূপভেদে জীব ও পরমের মিলনচেতনা, একটি বিন্দুকে মহাসিন্ধুর মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাই ভালোবাসা বা প্রেম। চারপাশের গাছপালা, তরুলতা, প্রবহমান নদী ও ঝরনাধারা, পাহাড়-পর্বত, আকাশ-বাতাস, পাখির কূজন, মন্থর ও উত্তাল তরঙ্গভঙ্গ সমুদ্রকল্লোল, মেঘপুঞ্জ, বৃষ্টি ও মাটির মধ্যে সাধকরা দেখতে পান স্রষ্টার প্রেমময় লীলা। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিই স্রষ্টার ভালোবাসার অপার মহিমা। রুমীর চিন্তা ও ভাষিকজগতে প্রবেশ করলে আমরা যেমন অনুভব করি, স্রষ্টার অপার লীলা, তাঁর প্রতি জীবের অপার্থিব অনুরাগ, মজিদ মাহমুদের ‘ভালোবাসা পরভাষা’র মধ্যেও আমরা এমন এক অনুভবের উচ্চমার্গীয় স্তরে পৌঁছে যেতে পারি।
ক) ‘তুমি যাকে ভালোবেসেছিলে কিংবা যে তোমাকে


সেই সব আলো ও পানির কণিকাগুলো এখন মৃত


অথবা পরিবর্তিত হয়ে ফিওে আসছে তোমারই কাছে


মনে রেখ সব বসন্ত ও গ্রীষ্মে তোমাকে অতিক্রম করে যাবে


বর্ষা ও শীত চিরস্থায়ী নয়;’ [স্বপ্নে ভালোবাসা খুঁজি না]

খ) ‘তুমি যখন কথা বলো আমার সাথে, তখন


সময় থেমে যায় গভীর স্তব্ধতায়


ভুলে যাই পৃথিবীতে কোনদিন রাত এসেছিল কি না


মাস ও ঋতুর গভীর পরিবর্তন; বসন্ত কিংবা শীত


বাইরে আলোকিত জোছনা; ভেতরে গভীর অন্ধকার


এর কোনো অর্থ ছিল না।’ [স্তব্ধ সময়]

গ) ‘ভাবতে, পৃথিবীতে এমন কে আছে মাতৃজঠর প্রসবিত


যে তোমাকে নক্ষেপ করবে অবজ্ঞার শর


যদিও এসবই তোমার বহিরাবরণ


যেমন শক্ত খোলসের মধ্যে ঢাকা থাকে সুমিষ্ট তালশাঁস’ [ স্বেচ্ছাচারী-সম্রাজ্ঞী]

ঘ) ‘মোগলের সা¤্রাজ্য উড়ে গেছে ইংরেজের ব্যাত্যাহতে


ইংরেজ আজ ভাঙা ব্রান্ডির বোতল


কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে মিলিত হওয়া পাথরগুলো


মানুষের প্রেম ও মহাকীর্তির ভাস্বর নিদর্শন হয়ে

আজো বাঁশি যেন ডাকো যমুনায়…’ [তাজমহল]

সভ্যতা বিলুপ্ত হয়, মানুষও এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। কিন্তু শাশ্বত প্রেমের মধ্যেই মানুষের কীর্তিগুলো বেঁচে থাকে অনন্তকাল। মানুষের নির্মাণকীর্তির মধ্যেই উপকরণগুলো মূল্যবান হয়ে ওঠে। কবিতা ব্যতিত শব্দগুলো নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ ছাড়া আর কী-ই গুরুত্ব বহন করে? কবির ভাব-অনুভব ও চিন্তার চিত্রকল্পে, সুক্ষ রসায়নে শব্দ অনিবার্য অমরতা পেতে পাওে শুধু মাত্র কবিতার কারণে। মজিদ মাহমুদ শব্দের যথাযথ প্রয়োগে শান্ত অনুরাগে প্রেমময় মহাকল্লোলের মধ্যে পাঠককে ভাসিয়ে দেন।

নিজের সৃষ্টি ছাড়াও ‘ভালোবাসা পরভাষা’য় কবি মজিদ মাহমুদ বিশ্বখ্যাত কবিদের পাঁচটি কবিতা এ বইয়ের শেষে অনুবাদ করেছেন। এগুলো হলো ‘শিকারি জারার গান সিত্যাকান্ত মহাপাত্র’, ষষ্ঠীসঙ্গীত শারম্যান আলেক্সি’, ‘৩০০১ জ্যাগ এগলিওর’, ‘আম আদমী কার্ল স্যান্ডবার্গ’, এবং ‘তাদের সঙ্গে থাকো’ মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি’। অনুবাদ হলেও পড়ে মনে হয় না এগুলো অনুবাদ। তাঁর কবিতার অনবদ্য যে ভাষাপ্রবাহ, অনুবাদের ক্ষেত্রেও তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অন্যভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা কিংবা বিশ্বখ্যাত কবির কাব্যভাবনার সাথে নিজের কাব্যচিন্তার দূরত্ব কিংবা নৈকট্য বোঝাতে হয়তো এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন কবিতাগুলো। যা-ই হোক না কেন, কবিতাগুলো পাঠ করলে বিশ্বকবিতার বীক্ষণস্রোতে মজিদ মাহমুদের সদম্ভ উপস্থিতিই পাঠক টের পাবেন।

কবিতার তথ্যসূত্র : ১। শ্রেষ্ঠ কবিতা আল মাহমুদ; ২। কাব্যসমুচ্চয় মজিদ মাহমুদ

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে