পৃথিবীর বুকে সবাই নিতে আসেন না। কেউ কেউ আড়ালে আবডালে থেকে নির্মাণ করেন সময়ের উচ্চারণ। কেউ কেউ শুন্য ক্যানভাসে আঁকেন দৃশ্যকল্প। কেউ কেউ ক্যানভাস সাজিয়ে তাতে শুধু তুলির আঁচড় দিয়ে পালিয়ে যান দৃশ্যপট ছেড়ে।
পরবর্তী দৃশ্য নির্মাণ করেন অন্যান্য কুশিলব শিল্পী। সৈয়দ নাজমুল করিম ছিলেন এক নির্মাতা। নির্মাণ শুরু করে বহু ক্ষেত্র ছেড়ে আড়ালে কাটিয়েছেন জীবন। জমিদারি রক্ত আর ঐতিহ্যপ্রিয় সৈয়দ নাজমুল করিম আমাদের হিজলের দেশের মানুষ। তিনি নেত্রকোণার সন্তান।
জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় তিনি নির্মাণ করে গেছেন। তিনি নির্মাণ করেছেন নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ, তিনি নির্মাণ করেছেন নজরুল সেনা। শানিত চেতনার অধিকারি এই ব্যাক্তি মানুষের অলক্ষ্যে জীবন কাটিয়েছেন।
তিনি অভিনয় শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশক। তার নির্দেশনায় দেখেছি খাটি ভুতের বাচ্চা নাটকটি। এই নাটকের কথা, লিরিক, প্যারোডিতে যৌথ ভাবে ছিলেন আমাদের কবি মনোয়ার সুলতান। তিনিও এই মাটির কবি।
আমার সাথে সৈয়দ নাজমুল করিমের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে অনেক পরে। যে সময়ে নেত্রকোণায় আমার পাঠ শুরু হয়েছে তার কিছু আগে তিনি সেই পাঠ চুকিয়ে ঢাকাবাসী হয়েছেন। অন্যান্য অনেকের মুখে তার নাম শুনেছি। শোনা কথায় জেনেছি তিনি নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
যাই হোক, গত বছর আমার একটি কবিতা তার নজরে আসে যেখানে খাসিকোনা গ্রাম আর মিয়া বাড়ির প্রসঙ্গ ছিলো। তার সূত্র ধরে একদিন তিনি আমাকে ফোন দিলেন।
ফোন দিয়ে জানান, হুমায়ূন আহমেদের অয়োময় নাটকের পটভূমি এই খাসিকোনা মিয়া বাড়ি। মির্জা চরিত্রটি এখন থেকে সৃষ্ট। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান। আমি শুধু জানি খাসিকোনা গ্রামে একটি মিয়া বাড়ি ছিলো। এক কালে তাদের প্রতাপ প্রতিপত্তি ছিলো। আমাদের বাসায় মতি মিয়া নামে একজন আসতেন। খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা থাকলেও তিনি খুব হাঁকডাক করে চলতেন। আমি তথ্য সংগ্রহ করে জানাবো বলে কথা শেষ করলাম।
তারপর থেকে তার সাথে আমার ফোনে কথাবার্তা হতো। অনেক জ্ঞান গর্ভ আলোচনা করতেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভূগোল, ভূরাজনৈতিক, জমিদারি প্রথা সহ সকল বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হলো, এই শিক্ষককে আরও আগে আমার পাওয়া উচিত ছিলো। তার সংস্পর্শে ইতিপূর্বে যারা এসেছেন তারা অনেকেই আলোকিত মানুষ। মিজান ভাই অর্থাৎ মিজান মল্লিকের সাথে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিলো জানতাম। মিজান ভাই হয়তো অনেক ভালোভাবে সৈয়দ নাজমুল করিমকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। এর মধ্যে আমি একটি সমস্যায় পড়ি। নেত্রকোণা শহরের মেছুয়া বাজারের গৌরীপুর কাচারী বাড়িটিকে ভূমি জাদুঘর ঘোষণা করা হয়। এই চিন্তা প্রথমে আমার মাথায় আসে ২০১৮ সালে।
বন্ধু সাংবাদিক সঞ্জয় সরকারের সাথে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা করেছি। সঞ্জয় এই চিন্তাটিকে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাথায় দিলে তিনি সেটিকে গ্রহণ করে একদিন সত্যি সত্যিই তিনি এটিকে ভূমি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম ভূমি জাদুঘর। এর মধ্যে এর উদ্ভোধন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো গৌরীপুর কাচারির ইতিহাস লিখে দিতে হবে। আমার মাথায় তখন হাত। খুব বেশি তথ্য আমি জানিনা। ঠিক তখন সকল তথ্য দিয়ে আমাকে মুক্ত করলেন সৈয়দ নাজমুল করিম। কিছু সহায়তা করলেন আলী আহমদ খান আইয়ুব। এসময় আমার মনে হলো, এ বিষয়ে সৈয়দ নাজমুল করিমের বিস্তর গবেষণা আছে। হয়তো অচিরেই তা দেখতে পাবো।
এইতো মাত্র পনেরো দিন হবে, তিনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। তখন দুপুরের খাবার খেয়ে আমি মাছ বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে অফিসের দিকে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে ফোন রিসিভ করলাম। জমি নামজারি বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলেন। আমি উত্তর দিলাম। শেষে বললেন, আমার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। আমার জন্য দোয়া করো। তারপর এই কয়দিন যোগাযোগ নেই। ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় বকুল তলায় ফেস্টুনে তার মৃত্যু সংবাদ দেখলাম। আঁতকে উঠলাম। তিনি আর ফোন দিবেন না?
সৈয়দ নাজমুল করিম জন্মেছিলেন মধ্য বসন্তে । তিনি চলেও গেলেন মধ্য বসন্তে। হাওরের ঢেউয়ের মতো তিনি যেন জন্মেই মরে গেলেন। আমরা আসলে জানিনা আমরা কি হারিয়েছি।
অনেকটা নিজেকে আড়ালে রেখেই জীবনের ভ্রমণ সমাপ্ত করেছেন সৈয়দ নাজমুল করিম। আড়ালেই আপনি ঘুমিয়ে গেছেন। আপনার এই ঘুম প্রশান্তির হউক।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম